সাগরতলে নামার প্রস্তুতি
জল আর চ্যালেঞ্জ—এই দুই জিনিস দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে ভালোবাসেন গুরু-শিষ্য দুজনই। দুজন মিলে খুঁজে ফেরেন সাগরতলের সৌন্দর্য, আর ছবি তোলেন অতল জলের অচেনা জগতের।
কাজী হামিদুল হক ও সালমান সাঈদ। এই দুই আলোকচিত্রী-অভিযাত্রীর চোখে আমাদের অতিপ্রিয় নারিকেল জিঞ্জিরা মানে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ধরা পড়েছে ভিন্ন এক রূপে। শুনুন বিস্তারিত।
‘১৯৯৪ সালে যখন প্রথম যাই, তখন সেন্ট মার্টিন দ্বীপে হাঁটুপানিতেই প্রবাল মিলত। এখন প্রবাল ধ্বংস হয়ে যেতে বসেছে। পানির অনেক নিচেও আর আগের মতো প্রবাল দেখা যায় না। এত এত জাহাজ ভিড়লে প্রবাল আর বাঁচে কী করে! তার পরও সেন্ট মার্টিনে বঙ্গোপসাগরের পানির নিচে প্রবালসহ যা আছে, তাও অসাধারণ। সাগরতলেই তো সম্পদ।’ কথাগুলো কাজী হামিদুল হকের। অভিজ্ঞ একজন ডুবুরি। ডুবসাঁতার দিয়ে সাগরের অতল জলে ঘুরে বেড়ান অবলীলায়। তবে সাগরতলে সৌন্দর্য শুধু নিজে একা একাই দেখেন না, নিজের হাতে গড়ে তোলেন অনেক সাঁতারু, অনেক ডুবুরি। আর সাগরের নিচে যা দেখেন, তা দেখাতে চান সবাইকে। পানির নিচে আলোকচিত্র তোলেন তিনি। স্থির, চলমান—দুটোই। বয়সে অনেক ছোট, তাঁরই শিষ্য সালমান সাঈদেরও এই শখ। জল আর চ্যালেঞ্জ—এই দুই জিনিস দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন। পানির নিচে ঘুরে বেড়ান, আর ছবি তোলেন অতল জলের অদ্ভুত জগতের। হামিদ আর সালমানের তোলা ছবি দেখে বিভ্রম জাগতেই পারে। প্রশান্ত মহাসাগর বা আটলান্টিকের অতলের ছবি নাকি এগুলো! যেমনটা আমরা দেখে থাকি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা ডিসকভারি চ্যানেলে। অত শত কিছু না। এসব ছবি তো আমাদের অতিপ্রিয় নারিকেল জিঞ্জিরা মানে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের। ভিন্ন ধারার এই দুই আলোকচিত্রী, অভিযাত্রীর কাছ থেকে জানা যায়, আমাদের সাগরতলের সৌন্দর্যের কথা। আবার শোনা যায়, প্রকৃতি দেখতে গিয়ে কীভাবে মানুষ প্রকৃতিকেই নষ্ট করছে। আমাদের হাতেই যেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে আমাদের অমূল্য সব রতন!
জলের তলে আশ্চর্য জগত্
‘এটা এক ভিন্ন জগত্। বড় বড় মাছের ঝাঁকে শত শত মাছ। ছোট-বড়, রঙিন, ডোরাকাটা, নানারকম নকশা কাটা মাছ। প্রবাল, সামুদ্রিক লতাগুল্ম। এক কথায়, ওপরের দুনিয়ার চেয়ে অনেক বেশি বর্ণিল।’ বললেন সালমান। তো এই জগতের ছবি না তুললে চলে! তাই রোমাঞ্চপ্রিয় সালমান চলে যান সাগরতলে, ক্যামেরা নিয়ে। যত সহজভাবে বলা হলো কথাটা, কাজটা তত সহজ নয়। প্রথমত ডাইভ দেওয়াটা শিখতে হবে, তারপর ছবি তোলাটা জানতে হবে, সবশেষে পানির নিচে ছবি তুলতে পারে, এমন ক্যামেরা লাগবে।
পানিরোধক করে ফেলতে হবে ক্যামেরাটা। এ জন্য লাগে হাউজিং—পানির নিচে ক্যামেরার আবাসন। হাউজিং ক্যামেরার এমন এক আবরণ, যা পানির চাপ সহ্য করে এবং ওটা ভেদ করে পানি ঢুকতে পারে না ভেতরে। ক্যামেরা থাকে শুষ্কই। এ জন্য বিশেষ ক্যামেরা। ফিল্মের যুগেও যেমন এ রকম ক্যামেরা ছিল, এখন তেমনি ডিজিটাল ক্যামেরাও আছে। হামিদুল হক, সালমান সাঈদ দুজনই এখন ব্যবহার করেন সিএনসির ডিজিটাল ক্যামেরা। সঙ্গে মাপমতো আবাসন। এখন প্লাস্টিকের হালকা আবাসন পাওয়া যায়। এসবের ওজন খুব কম। হামিদ এখন সিএনসির ডিজিটাল ক্যামেরার পাশাপাশি সনির ভিডিও ক্যামেরাও ব্যবহার করছেন। এটি সম্প্রচার করার উপযোগী মানের ছবি তুলতে পারে।
যন্ত্রপাতি থাকলেও পানির নিচে ছবি তোলার বেশ কিছু কায়দাকানুন আছে। সে সবের কিছুটা জানান হামিদুল হক। ক্যামেরা, লেন্স, আবাসনের পাশাপাশি ফ্ল্যাশলাইট বা আলো খুব জরুরি—স্থির বা চলমান দুই ধরনের ছবির ক্ষেত্রেই। ‘পানির নিচে দ্রুত রং বদলায়, রং হারায়। ১০ ফুট নিচে পানির যে রং, ২০ ফুট নিচে তা আর থাকে না। কমলা, সবুজ একেকটা রং ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। ৪০-৫০ ফুট নিচে গিয়ে রং হারাতে হারাতে নীলচে হতে থাকে। ৭০ ফুট নিচে তো প্রায় অন্ধকারই। তাই ফ্ল্যাশলাইট জরুরি।’ মাটির ওপরে ছবি তোলা আর পানির মধ্যে ছবি তোলার ঢের ফারাক ফোকাসের বেলায়। হামিদ বলেন, ‘পানিতে বস্তুর ওপর ফোকাস করার দূরত্ব (ফোকাললেন্থ) দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে ওয়াইড অ্যাঙ্গেলের লেন্স থাকে। বস্তুর একেবারে কাছে গিয়ে ছবি তুলতে হয়।’ এর ওপর আছে সময়ের ব্যাপার। অক্সিজেনের ভাণ্ড ট্যাংক নিয়ে গেলে অনেকক্ষণ থাকা যায়, আর নল লাগিয়ে ডুবসাঁতার দিলে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। যেমন, সালমান অনেক ছবি তুলেছেন মাত্র এক দেড় মিনিট পানির নিচে থেকে।
এই যে নল লাগিয়ে সাগরতলে ডুবসাঁতার—একে বলে স্নরকেলিং। নলের একটা দিক পানির ওপরে ভেসে থাকে। নলের আরেক প্রান্ত মাস্কের সঙ্গে নাকে লাগানো থাকে। আর অক্সিজেন ভাণ্ড নিয়ে যে ডুবসাঁতার, সেটা হলো স্কুবা ডাইভিং। ডুবুরির পিঠে বাঁধা থাকে অক্সিজেনের ভারী ভাণ্ড। সেটা থেকে দরকারি অক্সিজেন পায় ডুবুরি। স্কুবা ডাইভে বেশি নিচে নামা যায়, সাগরতলে থাকাও যায় অনেকক্ষণ। তবে দুটো পদ্ধতির যেকোনো একটি বেছে নিয়ে সাগরজলে নেমে পড়ার আগে অবশ্যই চাই প্রশিক্ষণ—হামিদুল হক আর সালমানের একই মত। ডুবুরির লাইসেন্স থাকাটাও উচিত। কারণ, কাজটা যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণও বটে। ‘বেড়াতে গেলাম, ডুবুরির পোশাক পরলাম, আর নেমে গেলাম সাগরজলে! ব্যাপারটা এমন নয়, এমন হওয়া উচিতও নয়।’ দুজনই এ কথা বললেন একসঙ্গে।
সাগরের সম্পদ
‘প্রবালের দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। প্রবালেই গড়ে উঠেছে। দ্বীপটি আগে খুব সম্পদশালী ছিল। দেখা যেত নানা রকম প্রবাল।’ বললেন সালমান সাঈদ। মগজের আকৃতির ব্রেন কোরাল, হরিণের শিংয়ের মতো দেখতে ডিয়ার হর্ন কোরাল—এসব বিপুল পরিমাণেই ছিল। আর হামিদুল হক তো জানালেন হাঁটু পানিতেই দেখা যেত প্রবাল, নিজেই দেখেছেন। সেন্ট মার্টিনে ছিল, ছেঁড়াদ্বীপ—সর্বত্রই ছিল। এখন সেন্ট মার্টিন থেকে দুই কিলোমিটার দূরে প্রবালের দেখা মেলে। ‘রক্ষা না করলে আর কিছু দিন পর কিছুই থাকবে না।’ বললেন হামিদুল হক। প্রবালের পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরের এ অংশটায় আছে সামুদ্রিক গাছগাছড়া, লতা-গুল্ম। আর আছে রঙিন মাছ, ঝাঁকে ঝাঁকে। ‘সাগরতলে নেমে আলো-আঁধারির নানা খেলা দেখা যায়। পানির নিচে তীর্যক কোণে আলোর রেখা নাচতে থাকে ঢেউয়ের তালে তালে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য, না দেখলে বোঝানো যাবে না।’ বললেন সালমান। যোগ করেন, ‘সবাই সেন্ট মার্টিনে যায়, ওপরের দৃশ্য দেখে, ফিরে আসে। কিন্তু সেন্ট মার্টিনের আসল ব্যাপারটা পানির নিচে।’ পানির নিচেই আসল সম্পদ। হামিদুল হকের মতে, পৃথিবীর নামকরা সাগরতলের দৃশ্য আর এই বঙ্গোপসাগরের নিচের দৃশ্য-সৌন্দর্যে তেমন কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না।
পানির নিচের জগত্টাকে দেখতে কোন সময়টা ভালো? সালমানের মতে, শীতকাল হচ্ছে ভালো সময়। আর দিনক্ষণ হিসেবে যেকোনো দিন দুপুর ১২টা থেকে দুইটা পর্যন্ত হলো ডাইভিংয়ের জন্য আদর্শ সময়। উজ্জ্বল আলোয় অতল জলের সৌন্দর্য যেন আরও ফুটে ওঠে।
আসলে এই অতলের জগত্টাই আলাদা। আলাদা তার সৌন্দর্যও। সেই জগত্টা ভালোই টানে রোমাঞ্চপ্রিয়দের। যেমন টানে হামিদ আর সালমানের মতো মানুষদের। এই দুজন যে শুধু সেন্ট মার্টিনের জলেই নামেন, এমন নয়। হামিদ কক্সবাজারের ইনানী সৈকতে ডাইভ করেছেন। সালমান সমুদ্র ছাড়াও ডাইভ করেছেন সাঙ্গু নদীতে। দেখেছেন কাঁকড়া, মাড ফ্রগ ইত্যাদি নানা কিছু। বর্ষায় হাওরাঞ্চলেও গেছেন তিনি। বর্ষায় ফুলেফেঁপে ওঠা হাওরে ডাইভ করেছেন অবলীলায়। তিনি জানালেন, বাংলাদেশে ডাইভ করার আরেকটি অপূর্ব স্থানের কথা। জায়গাটার পোশাকি নাম ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’। ডলফিনের প্রজননক্ষেত্র। হাঙরও আছে এখানে। আছে কচ্ছপ। বড় বড় তিমিও দেখা যায়এখানে। মানচিত্রে জায়গাটা সেন্ট মার্টিন আর সুন্দরবনের মাঝামাঝি বঙ্গোপসাগরে, গলাচিপার কাছে। সালমান বলেন, ডাইভ করার জন্য এটা খুব ভালো জায়গা। সুযোগ পেলেই নাকি যাবেন।
গুরুশিষ্য পরম্পরা
হামিদুল হকের বয়স ষাটের বেশি। জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, আসামে। একেবারে পাক্বা ডুবুরি। ২০০ ফুট গভীরতা পর্যন্ত ডাইভ করার লাইসেন্স পাওয়া ডুবুরি তিনি। এই বয়সে এখনো রোমাঞ্চকর অভিযাত্রায় সবার আগে থাকে তাঁর উত্সাহ। থাকবে নাই বা কেন, হামিদের পুরো জীবনটাই তো রোমাঞ্চে ঠাসা। বাবা ছিলেন ভূতাত্ত্বিক, খনি প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন পাকিস্তানে। ১৯৫৪ সালে হামিদ যান সেখানে। আবার ১৯৬০ সালে চলে আসেন রাজশাহীতে। মাধ্যমিকের পর ১৯৬৭ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে পাস করেন উচ্চমাধ্যমিক। এরপর পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান পড়তে যান। দুই বছর পড়ার পর পাড়ি জমান মার্কিন মুল্লুকে। আর্ট ইনস্টিটিউট অব বোস্টনে ভর্তি হন আলোকচিত্র নিয়ে। স্নাতক হন ১৯৭৪ সালে। এরপর চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে কোর্স করেন নিউইয়র্ক স্কুল অব মিডিয়া আর্টসে।
বিচিত্র শিক্ষাজীবনের পর শুরু হয় হামিদের বিচিত্র কর্মজীবন। নিউইয়র্কেই পরিচয় হয় প্রবীণ এক স্কুবা ডাইভারের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে জ্ঞানের বিনিময় হয়। তাঁকে ছবি তোলা শেখান হামিদ, আর বিনিময়ে হামিদকে তিনি শেখান স্কুবা ডাইভ। এরপর হামিদের পেশার চাকা ঘুরে যেতে থাকে অন্যদিকে। পেশাদার আলোকচিত্রী কাম স্কুবা ডাইভার হয়ে ওঠেন তিনি। তখন সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়। এরপর বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৯৪ সালে।
কাজী হামিদুল হকের কাছেই পানির নিচের কারিগরি শিখেছেন সালমান সাঈদ। প্রশিক্ষণ চলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিং আর ডাইভিং পুলে। ২০০৬ সালে প্রথম স্কুবা ডাইভ করেন। সালমান উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছেন ভারতের দার্জিলিংয়ে। এরপর ঢাকায় ফিরে এসে ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ থেকে সংবাদমাধ্যম ও যোগাযোগ বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন। এখন কাজ করেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায়। মা ফরিদা ইয়াসমিন ব্যাংকার। সালমান শুধু সাগরের গভীরে নামেন—এমনটা নয়, পাহাড়-পর্বতেও ওঠেন। একমাত্র ছেলে এমন অভিযানে যান, মা বাধা দেন না? ‘প্রথম প্রথম মানা করতেন। এখন তো মা নিজেও স্নরকেলিং করতে চান।’ তাই মধ্য বিশের সালমানের রোমাঞ্চকর অভিযানগুলোতে এখন বেশ উত্সাহ-উদ্দীপনা নিয়েই যেতে পারেন।
বাংলা চ্যানেলের গল্প
সেন্ট মার্টিনে সালমান সাঈদ প্রথম যান ২০০৬ সালে, সাঁতরে। বঙ্গোপসাগর সাঁতরেই পাড়ি দিয়েছেন যেন। তখনই পানির নিচে ছবি তোলার শখ মাথায় চাপে সালমানের। হামিদুল হকের কাছে শেখা শুরু করেন তখন থেকে। শাহপরীর দ্বীপ, মানে বাংলাদেশের মানচিত্রে থাকা দক্ষিণে সর্বশেষ মূল ভূখণ্ড থেকে সেন্ট মার্টিন—সাঁতারের জন্য এ পথটা বেশ উপযোগী। এই সমুদ্রপথই বাংলা চ্যানেল। চ্যানেলটি খুঁজে বের করেছেন কাজী হামিদুল হক। বাংলা চ্যানেলের কাহিনি জানতে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।
১৯৯৪। দেশে ফিরে আসার পর সমুদ্র টানছে হামিদুল হককে। বিদেশি এক বন্ধু পেশাদার ট্রেজার হান্টার (গুপ্তধন উদ্ধারকারী) তাঁকে বলেছেন, বঙ্গোপসাগরের কোনো কোনো জায়গায় ডুবে যাওয়া সওদাগরি নৌকা আছে। হামিদ তখন মানচিত্র ধরে ধরে শাহপরীর দ্বীপ আর সেন্ট মার্টিনের মাঝামাঝি জায়গা চিহ্নিত করেন। জানালেন, ‘এ অঞ্চল থেকে আরাকান উপসাগরের দিকে জেলেরা যেত। মালামাল নিয়ে বাণিজ্য নৌকাও যেত সে সময়। আর সমুদ্রের এ জায়গায় নৌকাডুবিও হতো।’ মোটামুটি কিছু জায়গা চিহ্নিত করে ডাইভ দেওয়া শুরু করেন হামিদ। ‘সাগরের নিচে কিছু সওদাগরি নৌকাও পেলাম। কিন্তু এসব জায়গায় পলি জমা হয় বেশি। নৌকা আছে, তবে সেগুলো তিন-চার ফুট পলির নিচে চাপা পড়ে গেছে। আমার একার পক্ষে সেসব উদ্ধার করা সম্ভব নয়।’ গুপ্তধনের কাহিনি এখানেই শেষ। তবে লাভ যেটা হয়েছে, সেটা হলো, সে সময়টায় প্রচুর সাঁতার কেটেছেন হামিদ। তখনই তাঁর মাথায় আসে শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্ট মার্টিন সাঁতারের ব্যাপারটা। এরপর নানারকম প্রস্তুতি নিয়ে ২০০৬ সালে এই ১৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার সমুদ্রপথে সাঁতারের আয়োজন করেন। পথটার নাম দেন ‘বাংলা চ্যানেল’। এরপর এই চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার অনেক উদাহরণই তৈরি হয়েছে। চ্যানেলটিতে সাঁতার কাটতে হয় ভাটার সময়। সমুদ্রের স্রোতে স্রোতে গা ভাসিয়ে স্রোতের গতিপথ বুঝে বুঝে পৌঁছে যেতে হয় সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। সময় পাওয়া যায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার মতো। এর মধ্যেই পাড়ি দিতে হবে বাংলা চ্যানেল। নইলে জোয়ার যে এসে যাবে!
বাঁচাও সেন্ট মার্টিন
সালমানের ডিজিটাল ক্যামেরায় মাত্র কয়েক দিন আগের তোলা কিছু ছবি দেখা গেল। ছবিগুলো অবশ্যই সাগরতলের। একটা ছবিতে দেখা গেল, সাগরের নিচে চকচকে সবুজ কী যেন একটা জিনিস। ভালো করে দেখে বোঝা গেল, সেটা একটি চিপসের পরিত্যক্ত প্যাকেট। আরেকটি ছবি দেখা গেল প্রবালে পেঁচিয়ে আছে রশি। অন্য এক ছবিতে প্রবালের বুকে জাহাজ বা নৌকার নোঙর।
এভাবেই সেন্ট মার্টিনের প্রবাল ধ্বংস হচ্ছে। হামিদুল হক জানালেন, ‘অসংখ্য আণুবীক্ষণিক জীব দিয়ে একেকটি প্রবাল তৈরি হয় বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু প্রবাল খুবই স্পর্শকাতর। তিন দিন সূর্যের আলো না পেলে মরে যায়। এখন সেন্ট মার্টিনে পর্যটকেরা গেলে তাদের টাকার বিনিময়ে ডাইভ দেওয়ার সুযোগ করে দেয় কিছু মানুষ। সাঁতার না জানলেও হবে। দুই, আড়াই বা তিন হাজার টাকা নিয়ে ডুবুরির পোশাক পরিয়ে কোমরে রশি বেঁধে নামিয়ে দেওয়া হয় পানির নিচে। তারপর সেই ব্যক্তি নিচে প্রবালের ওপর হেঁটে বেড়ায়। প্রবাল শেষ!’
হামিদ ও সালমান আরও জানালেন, দ্বীপের পশ্চিম পাশে যে বড় বড় পাথর ছিল, সেগুলো সরিয়ে জাহাজ রাখার জায়গা বের করা হয়েছে। আবার পাথর তুলে তুলে দ্বীপটিতে নির্মাণকাজে বহন করা হয়। মূল ভূখণ্ড থেকে ইট আনা তো অনেক ব্যয়বহুল। এভাবেই নষ্ট করা হচ্ছে সেন্ট মার্টিনের সৌন্দর্য। ‘নারকেলগাছ তো অনেক জায়গাতেই আছে, সেন্ট মার্টিনে সেটা দেখতে কতজনে যাবে? দ্বীপটির সম্পদ তো পানির নিচে। তাই একে রক্ষা করা দরকার’ বললেন তিনি।
রক্ষা করার কিছু বুদ্ধিও বাতলে দিয়েছেন তিনি। শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত কেব্ল কার চালু করা যায়। এটা হলে জাহাজ ভেড়া যেমন কমানো যাবে, তেমনি এই কেব্ল কারে ভ্রমণই পর্যটকদের কাছে এক দারুণ আকর্ষণ হবে। দ্বীপে থাকবে ফাইবার কাচের তৈরি নৌকা, যার স্বচ্ছ তলা দিয়ে দেখা যাবে পানির নিচে থাকা প্রবাল।
একবার এক বিশাল বয়া বানানো হয়েছিল হামিদুলের উদ্যোগে। উদ্দেশ্য ছিল, বয়ার গায়ে নোঙর ফেলবে জাহাজ বা নৌকাগুলো। চালু করার ছয় মাসের মধ্যে সেই বয়া চুরি হয়ে যায়। জানালেন, এবার একটা তথ্য সংগ্রহ করব। দ্বীপটির হোটেলগুলোর বাথরুম পরিষ্কারের জন্য প্রতিদিন কী পরিমাণ জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হয়। এসব জীবাণুনাশক তরল তো শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের পানিতে গিয়ে মেশে। আর এসব তো বিষাক্ত তরল। ‘সেন্ট মার্টিনকে আসলে গবেষণা দ্বীপ হিসেবে গড়ে তোলা দরকার। প্রবালের পুনর্বপন হবে, সমুদ্রেই হবে মাছদের অ্যাকুরিয়াম, তবেই তো সেন্ট মার্টিনের প্রকৃত সম্পদ ধরে রাখা যাবে।’ বললেন কাজী হামিদুল হক।
জলবায়ুর পরিবর্তন বা বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে সেন্ট মার্টিনের ক্ষতি হবে কি হবে না, তা ভাবার আগেই দ্বীপটির ক্ষতি হচ্ছে মানুষের দ্বারা। হাতের লক্ষ্মী পায়ে না ঠেলে এখন যেটুকু সম্পদ আছে সেন্ট মার্টিনে, সেটুকু রক্ষা করা দরকার। তবেই হয়তো সালমানদের উত্তর পুরুষেরা ডাইভ দিয়ে সাগরতলের অপার সৌন্দর্য অমূল্য সম্পদ দেখার সুযোগ পাবে। আগামী দিনের জন্য যা খুবই জরুরি।
Recent Comments